বিগত বছরের অর্থাৎ ২০১৯ এর তুলনায় এই বছরের প্রথমে প্রান্তিকে এসে থমকে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। এর মুল কারন হচ্ছে Corona Virus । যার প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। এর মধ্যে এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশের শেয়ার বাজারের সুচক কমেছে অনেকগুন। ভাইরাসের উৎপত্তি স্থল চীন এর শাংহাই কম্পোজিট এর সুচক পড়েছে প্রায় ৮ ভাগ এর মতন যা বিগত বছর অর্থাৎ ২০১৯ এর মধ্যে সর্বনিম্ন। এছারাও, আন্তর্জাতিক বাজারও হারিয়েছে দর। গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকনোমিকএক্স এর মতে এই বছরের বৈশ্বিক অর্থনীতির পব্রিদ্ধি হতে পারে ২.৩% যা ছিল ৪.২% এর কাছাকাছি। ফরেক্স ট্রেডিং এও আমরা এই Corona Virus এর প্রভাব লক্ষ্য করতে পারছি।
Corona Virus এর শুরু
ভাইরাস এর সুত্রপাত হয় চীনের উহান শহর থেকে যা বিগত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রথম ধরা পরে। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সময় বাড়ার সাথে সাথে মহামারি আকার ধারন করে। এক পর্যায়ে এই ভাইরাস এর প্রভাব ঠেকানোর জন্য চীন সরকার উহান শহর এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং যার ফলশ্রুতিতে উহান এর সাথে চীন এর অন্যান্য দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
এই বছর জানুয়ারি এর শেষদিকে এসে ভাইরাস সংক্রমিত হয় চীন এর অন্যান্য শহরগুলোতেও সেই সাথে এটি ছড়িয়ে পরে অন্যদেশগুলোতেও। ভাইরাস এর সংক্রমন ঠিক তখনই ধরা পরে যখন চীন তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব লুনার নব-বর্ষের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য, চীন সরকার সকল ধরনের উৎসব আয়োজন বাতিল বলে ঘোষণা দেয়।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ এর দিকে এসে এই Corona Virus মহামারি আকার ধারন করে যার ফলে এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর পরিচালক এটিকে মানব-সভ্যতার জন্য হুমকি-স্বরূপ বলে ঘোষণা প্রদান করে। তবে ইতিমধ্যেই কিছুটা ভাইরাস এর প্রভাব চিনে কিছুটা কম হলেও বেড়েছে অন্যান্য দেশে। যার ফলে প্রায় বন্ধই রয়েছে ইউরোপের সকল দেশ।
Corona Virus এর আতঙ্কে বিশ্ব
দ্রুত এই ভাইরাস এর সংক্রমন ঘটার ফলে চীন এর জনগন এর উপরে কড়াকড়ি আরোপ করে বহির্বিশ্ব। যেহেতু এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস এর কোনও ধরনের প্রতিষেধক আবিষ্কার সম্ভব হয়নি তাই প্রায় সকল দেশই তাদের দেশে চীনা নাগরিকদের সকল ধরনের ভ্রমণ এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এখন পর্যন্ত চীন এর বাইরে, ফিলিপাইন, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ, থাইল্যান্ড সহ বেশকিছু দেশে এই ভাইরাস এর সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছে। যার ফলে এসব দেশ তাদের সকল নাগরিকদের চীন ত্যাগ এবং ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইতিমধ্যেই ভাইরাস এর শিকার হয়েছে প্রায় ১৪৬ দেশের জনগন এবং এর মদ্ধে বাদ যায়নি বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশ। এখন পর্যন্ত চিন এর ভাইরাস এর প্রকোপ কিছুটা কমলেও বেড়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে ইতালি।
ইতিমধ্যেই ইতালি সরকার, দেশে সকলকে নিজ বাড়ি থেকে বের না হবার নির্দেশনা জারি করেছে এবং গঠন করা হয়েছে ভাইরাস পুলিশ। কোনও ধরনের আদেশ ছাড়া বাড়ি থেকে বের হলেই হচ্ছে জরিমানা জেল। প্রায় ৬ কোটি মানুষ রয়েছে হোম কোয়ারেন্টাইনে।
বিশ্ব বাজারে Corona Virus এর প্রভাব
আমরা সবাই জানি, চীন হচ্ছে রপ্তানিনির্ভর দেশ। বড় বড় সকল দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন, বিপনন এবং ব্যবসায়িক শাখা রয়েছে এই চীনে। চীন এর সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারনে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অফিস বন্ধ করে রেখছে চীনে যার প্রভাবে প্রায় ভেঙে পড়েছে সাপ্লাই-চেইন ব্যবস্থা। চীন এর উহান শহরকে বলা হয়ে থাকে Manufacturing Hub যেখানে রয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৩০০টির বেশী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম। বড় বড় অটমোবাইল কোম্পানি যেমন, Honda, Nissan, General Motors সহ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান Apple, Microsoft, Google এর কার্যক্রমও পরিচালিত হয় এই শহর থেকেই। ইতিমধ্যেই এরা চীনে তাদের সকল কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে।
উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হবার কারনে, কমে গেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপনন ব্যবস্থা। এছারাও এয়ারলাইনগুলো তাদের সকল ধরনের কমার্শিয়াল ফ্লাইট বাতিল করারও ঘোষণা প্রদান করে। যার ফলে বিপাকে পড়েছে বিভিন্ন দেশের সাথে চীন এর পণ্য পরিবহন এবং বিপনন ব্যবস্থা।
গত সপ্তাহের শুক্রবার, আমেরিকা ইউরোপের সাথে সকল ধরনের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল এর ঘোষণা দেয়। যার ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়ে সকল বিমান এবং পর্যটনখাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। যার প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়েছে নামাদামি সকল দেশের শেয়ার মার্কেটে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বৈশ্বিক অর্থনীতি।
পুঁজি বাজারে Corona Virus এর প্রভাব
এই বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চীন এর শেয়ার বাজার, শাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কম্পোজিট এর সুচক কমেছে প্রায় ১১ ভাগ যা বিগত বছরের তুলনায় সবচেয়ে কম এবং যার প্রভাবে বাজার মুল্ধন কমেছে প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন ডলার। তারল্য সংকট কাটানে নতুন করে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার পরিমান মুদ্রা ছেড়েছে চীন এর কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার গবেষক S&P Analytics এর মতে, যদি খুব তাড়াতাড়ি এই ভাইরাস দমন করা সম্ভব না নয় তাহলে সম্পূর্ণ ক্ষতির পরিমান হতে পারে ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার এর কাছাকাছি।
অন্যদিকে, Japan এর Nikkei 225, DoW 30 এবং NASDAQ সহ সকল শেয়ার বাজারই তাদের সুচক হারিয়েছিল এই বছরের শুরুতে। এই মার্চ এর শুরু থেকেই সকল দেশের শেয়ার মার্কেট এর দরপতন রয়েছে অব্যাহত। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ এর দর হারিয়ে প্রায় ৩৩ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। বাদ যায়নি লন্ডন স্টক মার্কেট এবং এশিয়ান স্টক মার্কেটগুলোও।
ফরেক্স ট্রেডিং Corona Virus এর প্রভাব
রপ্তানি নির্ভর দেশ চীন এর এই অচলাবস্থার কারনে সবচেয়ে বেশী খারাপ সময় পার করছে তেল। বিগত এক মাসে Brent Crude Oil এর মূল্য কমেছে ব্যারেল প্রতি প্রায় $16 ডলার। এর মুল কারন হচ্ছে, চীন এর উৎপাদনমুখী সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারনে বিশ্ববাজার থেকে তাদের প্রতিদিনের তেল এর যেই চাহিদা ছিল সেটি কমে গেছে প্রায় ২২ ভাগ। ক্যাম্ব্রিজ এনালিটিকা এর হিসাবে প্রতিদিন প্রাউস ৫৬ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করত দেশটি যেটির পরিমান এখন অনেকাংশে কমে গিয়েছে।
এমতাবস্থায় OPEC এবং NON OPEC ভুক্ত সকল দেশ তাদের দৈনিক তেল উৎপাদনের হার কমিয়ে নিয়ে আসার ঘোষণা প্রদান করেছে। তবে রাশিয়া এবং ওপেক ভুক্ত দেশগুলোর সাথে বিরধ এর কারনে তেল এর দাম কমে আসে প্রায় ২৮ ডলার ব্যারেল প্রতি যা বিগত ২৮ বছরের তেল এর কম দিনের সর্বাধিক দরপতন।
অন্যদিকে সবচেয়ে বেশী পরিমান মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে GOLD এর। যেটি এই বছরে সর্বাধিক 1611 ডলার মূল্য স্পর্শ করে। এছারাও, রপ্তানি নির্ভর অন্য আর একদেশ জাপান তাদের মুদ্রার মান হারিয়েছে প্রায় ২ ভাগ এর কাছাকাছি।