ফরেক্স ট্রেডিং থেকে প্রফিট- মনে করুন, বাংলাদেশ থেকে ১০০,০০০ ব্যাক্তি ফরেক্স ট্রেডিং করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এরা সবাইকি সফল? উত্তর হচ্ছে না! এদের মধ্যে সফলতার রেশিও হচ্ছে ৫% এর কম।
ট্রেডার হবার কারন
প্রথমেই বলেছি, আমাদের দেশে সফল ট্রেডারের সংখ্যা সর্বাধিক ৫% পর্যন্ত হতে পারে। তবে এর বেশী হবেনা। কি মনে হচ্ছে, আমরা মনগড়া তথ্য দিচ্ছি? না! আমাদের সাথে যুক্ত প্রায় ১৬,০০০ ট্রেডারকে নিয়ে আমরা ২০২১-২০২২ সালে একটি সার্ভে করি। সেখান থেকে বেশকিছু তথ্য (ড্যাটা) গ্রহন করার পর সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে, আমরা বুঝতে পারি, বাংলাদেশ থেকে যারা ট্রেড করছেন তাদের ৯৫% লসই করে যাচ্ছেন। কোনও কোনও ব্যাক্তির ক্ষেত্রে এই লসের পরিমাণ প্রায় ৩০ লক্ষ টাকারও উপরে।
এরপরও সবাই ট্রেডার হবার স্বপ্ন দেখে। এর কারন কি? কারন হচ্ছে সবাই মনে করে ট্রেডিং থেকে সহজে এবং অল্প সময়ে বড় আকারের প্রফিট করা সম্ভব। এই মানুশিকতার কারনেই সবাই মুলত ট্রেডার হতে আগ্রহী।
বেশীরভাগ মানুশই এই চিন্তা নিয়ে ট্রেড শুরু করেন, অল্প সময় এবং কম বিনিয়োগ করার মাধ্যমে সহসাই ব্যাপক এমাউন্টের টাকা উপার্জন করা সম্ভব। আপনি হয়তোবা এমন বিশেষ বিজ্ঞাপনও দেখেছেন, যেখানে প্রচার করা হচ্ছে “ট্রেডিং শুরু করুন আর ধনী হয়ে যান”।
অন্যদিকে, অনেকেরই ইচ্ছা থাকে সাধারন চাকুরী কিংবা ব্যবসা করার সাথে সাথে অতিরিক্ত উপার্জনের উৎস হিসাবে ফরেক্স ট্রেডিং করবেন। এবং এই চিন্তা থেকে ট্রেডিং শুরুও করেন তবে লস ব্যাতিত কিছুই হয়না। মুলত ফরেক্স ট্রেডারদের লস হবার পিছনে মুলত একাধিক কারন থাকলেও, প্রধান কারন হচ্চে মুলত একটি। আর সেটি হচ্ছে – ফরেক্স ট্রেডিং এর প্রফিট ক্যালকুলেশন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা। চলুন কিছুটা সহজ করে বোঝার চেষ্টা করি।
ভিন্ন পেশায় মাসিক উপার্জন
সবাই ট্রেড করে প্রফিট করার জন্য। কেউ সময় কাটানোর জন্য ট্রেড করে না। সত্যি এবং এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সমস্যা হচ্ছে, এই উপার্জন সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারনা থাকা। একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।
ধরুন, আপনি এমন কিছু করেন যেখান থেকে প্রতিমানে ১ লক্ষ (১০০,০০০) টাকা অ্যায় হয়। সেটি চাকুরী কিংবা ব্যবসা যেকোনো কিছুই হতে পারে। এখন এই ১ লক্ষ টাকা হিসাবে আপনার প্রতিদিনের আয় কত?
(১০০,০০০ / ৩০ = ৩,৩৩৩) টাকার মতন।
অর্থাৎ, প্রতিদিন আপনার উপার্জন হচ্ছে, ৩,৩৩৩ টাকা ৩০ দিনের হিসাবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই টাকা আয় করার জন্য আপনাকে কি করতে হয়? যেমন ধরুন, আপনি যদি চাকুরীজীবী হয়ে থাকেন তাহলে সপ্তাহের ৫দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিসে সময় দিতে হবে। এর বাইরে অতিরিক্ত আরও ২/৩ ঘণ্টা লাগবে, বাসা থেকে অফিসে যাওয়া এবং আসা মিলিয়ে।
অর্থাৎ, প্রতিদিন প্রায় ১০/১১ ঘণ্টা আপনাকে আয় করার পিছনে সময়ে দিতে হবে। তাহলেই কেবল আপনি মাস শেষে সেই কাঙ্ক্ষিত ১০০,০০০ টাকা বেতন পাবেন।
অন্যদিকে, আপনি যদি ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন তাহলে সেটির হিসাবে আপনিই করে নিতে পারবেন।
এবার ভালো করে চিন্তা করে বলুন, ১০০,০০০ টাকা মাসে আয় করার জন্য কি পরিমাণ কষ্ট আপনাকে করতে হয়! তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ফরেক্স ট্রেডিং করে আয় করার ক্ষেত্রে কেন আপনি এই কষ্ট করতে পারবেন না!
এবার চিন্তা করুন, আপনি কারও কাছ থেকে ফরেক্স ট্রেডিং সম্পর্কে জানতে পারলেন। এবং চিন্তা করলেন চাকুরী ছেড়ে দিয়ে নিজেই ফুলটাইম ট্রেডার হয়ে যাবেন। সেই হিসাবে আপনি ভালো একটি এমাউন্ট বিনিয়োগ করলেন এবং ট্রেডিং করার শুরু করলেন।
এখন কি হলো?
ট্রেডিং থেকে মাসিক উপার্জন
ট্রেডিং শুরু করার কয়েকদিন যেতেই, আপনি মনে থাকলো এখান থেকে প্রতিমাসে ২/৩ লক্ষ টাকা আয় করা কোন ঘটনাই না! সহজেই করে ফেলা সম্ভব। এই হচ্ছে সমস্যার মুল উৎপত্তি। অর্থাৎ, বেশী প্রফিট করার প্রবণতা।
বেশী প্রফিট করার চিন্তা কেন ভুল, সেটি নিয়ে কিছুটা পরে আলোচনায় আসছি।
প্রথমে জেনে নেয়া যাক, ট্রেডিং থেকে প্রতিমাসে ১ লক্ষ টাকা আয় করতে হলে, আপনাকে কি কি করতে হবে।
মনে করুন, প্রতি মাসে এই পরিমাণ অর্থ আয় করার জন্য স্ট্যান্ডার্ড 0.10 লট কিংবা ভলিউম এর এন্ট্রি গ্রহন করতে হবে। যেখান থেকে প্রতি মাসে আপনাকে কমপক্ষে ১০০০ পিপ্স পরিমাণ প্রফিট করতে হবে। প্রতি পিপ্স এর জন্য ১০ সেন্ট (USD) হিসাবে –
(১০০০ পিপ্স * লট ০.১০) X ১০ সেন্ট = ১০০০ ডলার (USD)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ১০০০ ডলার প্রতি মাসে আয় করার জন্য প্রতিদিনের হিসাবে কি পরিমাণ প্রফিট করা প্রয়োজন?
১০০০ / ২২ (শনি এবং রবি ব্যাতিত) = ৪৫+ ডলার
আশা করি, ক্যালকুলেশনটি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন।
এখন সবথেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিমাণ প্রফিট আয় করতে হলে, আপনাকে কি পরিমাণ ফান্ড বিনিয়োগ করতে হবে?
ট্রেডিং বিনিয়োগ ক্যালকুলেশন
ফরেক্স ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে, বিনিয়োগ করার নির্দিষ্ট কোন সীমা কিংবা বাধ্যবাধকতা নেই। এবং সঠিক পরিমাণ বিনিয়োগ করার কোন স্ট্যান্ডার্ডও নেই। তবে কিছু বিষয় সম্পর্কে জানা থাকলে, সঠিক পরিমাণ বিনিয়োগ করা সহজ হয়ে যাবে। সেই ক্যালকুলেশনটি আমরা জানার চেষ্টা করবো।
মনে করেন, আপনার কাছে ৫ লক্ষ টাকা আছে, যেটি আপনি একটি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট (FD) করে রাখতে আগ্রহী। এতে করে ব্যাংক আপনাকে ৮-১০% হিসাবে সুদ প্রদান করবে। অর্থাৎ, যদি ১০% ইন্টারেস্ট হিসাব করি তাহলে বছরে ৫ লক্ষ টাকা থেকে আপনার আয় হচ্ছে,
৫০০,০০০ * ১০% = ৫০,০০০ টাকা।
সেই হিসাবে মাস প্রতি আপনার আয় হচ্ছে,
৫০,০০০ / ১২ = ৪,১৬৬ টাকা
ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে প্রতি মাসে আপনাকে যদি ১০০,০০০ টাকা আয় করতে হয় তাহলে আপনাকে অবশ্যই সেই অনুপাতে ফান্ড বিনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, সর্বাধিক ১০% প্রফিট রিটার্ন টার্গেট সেট করে নিতে পারেন। অর্থাৎ, আপনার বিনিয়োগের পরিমাণ হতে হবে –
১০০,০০০ * ১০ = ১০,০০,০০০ টাকা
এখন আপনার মনে হতে পারে, মাত্র ১ লক্ষ টাকা প্রতি মাসে আয় করার জন্য আমাদের ১০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে?
উত্তর হচ্ছে, হ্যা। কেননা, প্রতি মাসের হিসাবে আপনার ফরেক্স ট্রেডিং থেকে যদি আয়ের পরিমাণ বেশী টার্গেট থাকে, তাহলে আপনার বিনিয়োগের পরিমাণও সেই অনুপাতেই হতে হবে।
এখন আপনি যদি মনে করেন, ১০০০ ডলার বিনিয়োগ করেই প্রতি মাসে ১,০০০ ডলার আয় করবেন, তাহলে ভাই সেটি সম্ভব নয়! বাংলাদেশে অনেকেই আছেন যাদের শুধুমাত্র ফরেক্স ট্রেডিং থেকেই মাসে ১০,০০,০০০ টাকার উপর আয় আসে। তবে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণও সেই লেভেলের।
আমার কিংবা আপনার মতন ১০০ কিংবা ১০০০ ডলার নয়!
ফরেক্স ট্রেডিং এর জন্য সঠিক পরিমানের বিনিয়োগ অনেক বড় একটি ফ্যাক্টর। কেননা যদি বিনিয়োগের পরিমাণ যথেষ্ট না হয় তাহলে প্রফিটের পরিমাণও যথেষ্ট হবেনা। অর্থাৎ, আপনি বেশী পরিমাণ অর্থ উপার্জন করার চাহিদাও রাখতে পারবেন না।
এখন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি অল্প পরিমাণ ফান্ড ডিপোজিট করে ট্রেড করা সম্ভব নয়? সম্ভব! তবে সেক্ষেত্রে প্রতি মাসে আপনার প্রফিট করার চাহিদাও কমিয়ে আনতে হবে।
যেমন ধরুন, প্রতি মাসে যদি ১০০ ডলার আয় করতে চান, তাহলে ১০% রিটার্ন হিসাবে আপনার বিনিয়োগ করতে হবে ১০০*১০ = ১০০০ ডলার।
তদ্রূপ, আপনি যদি ১০০ ডলার ডিপোজিট করেন তাহলে ১০% হিসাবে আপনার প্রফিট রিটার্ন হবে ১০ ডলার এর কাছাকাছি।
পরামর্শ
ফরেক্স ট্রেডিং হচ্ছে “টাকার স্থান” এবং একটি প্রবাদ আছে, “টাকায়, টাকা আসে”। সে হিসাবে আপনার বিনিয়োগ যদি বেশী পরিমাণের হয় তাহলেই কেবল আপনি বেশী প্রফিট টার্গেট করতে পারেন। এখন যদি আপনি ১০০০ ডলার ডিপোজিট করে প্রতি মাসে ৫০০ ডলার প্রফিট প্রত্যাশা করেন, সেটি জুয়ায় পরিণত হয়ে যাবে।
আপনি ১০০০ ডলার দিয়ে চাইলে এর থেকেও বেশী পরিমাণ আয় করতে পারেন। কেননা, ফরেক্স ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে আয়ের কোণও সীমাবদ্ধতা নেই। আপনি সক্ষম হলে, এর থেকেও বেশী প্রফিট করতে পারবেন। তবে সবসময় সেটি সম্ভব হবেনা।
এমন অনেক সময়ই হবে, একটি এন্ট্রি পজিশন থেকে ২০০ ডলার পরিমাণ প্রফিট করলেন, পরবর্তীতে অন্য একটি এন্ট্রি পজিশন থেকে আপনার ৩০০ ডলার লস হয়ে গেল।
তাই সবসময়ই রিস্ক-ম্যানেজ করার মাধ্যমে ট্রেড করতে হবে।
ফরেক্স ট্রেডিং এর জন্য কি পরিমাণ বিনিয়োগ করবেন, সেটি আপনার নিজস্ব ব্যাপার। তবে যদি আমাদের পরামর্শ চান, তাহলে বলবো – প্রথমে ঠিক করুন, প্রতি মাসে আপনার কি পরিমাণ রিটার্ন লাগবে। সেই হিসাবে ১০ গুন করে এমাউন্ট বিনিয়োগ করবেন।
যদি আপনার প্রফিট টার্গেট হয় ১০০ ডলার, সেই হিসাবে আপনার বিনিয়োগের পরিমাণ হতে হবে ১০০০ ডলার। প্রফিট রিটার্ন যতবেশী প্রত্যাশা করবেন, আপনার বিনিয়োগের পরিমাণও হবে ততবেশি। এখন আপনি ঠিক করবেন, আপনি কি পরিমাণ রিটার্ন প্রত্যাশা করেন।
এখন এই পরিমাণ ফান্ড বিনিয়োগ করার সক্ষমতা যদি আপনার না থাকে, তাহলে ফরেক্স ট্রেডিং আপনার জন্য নয়। অনুগ্রহ করে ভিন্ন কোনও ব্যবসা কিংবা পেশা নির্বাচন করে নেয়ার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনার সময় এবং অর্থ দুইটি’ই বেঁচে যাবে।
বাংলাদেশি ট্রেডারদের মধ্যে সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এই ফান্ড ক্যালকুলেশন। কেননা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ট্রেডাররা অল্প পরিমাণ ফান্ড ডিপোজিট করে বড় পরিমাণের প্রফিট করার স্বপ্ন দেখেন। ফলশ্রুতিতে, লস ব্যাতিত আর কিছুই কপালে জুটবেনা।
সবসময় মনে রাখবেন, আপনি ট্রেডে লস করলেই ব্রোকারের প্রফিট হয়! অর্থাৎ, আপনি যতবেশী পরিমাণ লস করবেন, ব্রোকার ততবেশী আয় করতে সক্ষম হবে। সুতরাং, এখন সিদ্ধান আপনার।
নিজের আয় করার জন্য ট্রেড করবেন, নাকি ব্রোকারের আয়ের জন্য ট্রেড করবেন।
আশা করি আর্টিকেলটি আপনার ভালো লেগেছে। এই আর্টিকেল সম্পর্কিত বিশেষ কোনও প্রশ্ন থাকলে আমাদের জানাতে পারেন কিংবা নিচে কমেন্ট করতে পারেন। প্রতিদিনের আপডেট ইমেইল এর মাধ্যমে গ্রহনের জন্য, নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করে নিতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো টিউটোরিয়াল দেখার জন্য অনুগ্রহ করে আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন। এছাড়াও, যুক্ত হতে পারেন আমাদের ফেইসবুক এবং টেলিগ্রাম চ্যানেলে। এছারাও ট্রেড শিখার জন্য জন্য আমাদের রয়েছে বিশেষায়িত অনলাইন ট্রেনিং পোর্টাল।